রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলকে "সৌর মডেল" (Solar System Model) বলা হয় কারণ এটি আমাদের সৌরজগতের গঠনের সাথে মিল রাখে।
কেন সৌর মডেল বলা হয়?
-
নিউক্লিয়াস = সূর্য
- রাদারফোর্ডের মতে, পরমাণুর কেন্দ্রে একটি ছোট, ঘন, ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস থাকে, যা সূর্যের মতো কেন্দ্রে অবস্থান করে।
-
ইলেকট্রন = গ্রহ
- নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনগুলো উচ্চ গতিতে ঘূর্ণন করে, যেমন গ্রহগুলো সূর্যের চারদিকে আবর্তিত হয়।
-
পরমাণুর অধিকাংশ স্থান ফাঁকা = সৌরজগতের শূন্যস্থান
- যেমন সৌরজগতের অধিকাংশ স্থান ফাঁকা, তেমনি পরমাণুরও বেশিরভাগ অংশ ফাঁকা।
সীমাবদ্ধতা:
- ক্লাসিক্যাল তত্ত্ব অনুযায়ী, ইলেকট্রন যদি কক্ষপথে ঘোরে, তবে তা শক্তি বিকিরণ করে ধীরে ধীরে নিউক্লিয়াসে পতিত হওয়ার কথা, যা প্রকৃতপক্ষে ঘটে না।
- এটি পরমাণুর বর্ণালী ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়।
এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য নীলস বোর ১৯১৩ সালে বোরের পরমাণু মডেল প্রস্তাব করেন, যেখানে ইলেকট্রন নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে থাকে এবং কোয়ান্টাইজড শক্তি গ্রহণ বা নির্গত করে এক কক্ষপথ থেকে অন্য কক্ষপথে যায়।
নীলস বোরের পরমাণু মডেল (Bohr's Atomic Model) – 1913
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করার জন্য ১৯১৩ সালে ডেনিশ বিজ্ঞানী নীলস বোর (Niels Bohr) তার কোয়ান্টাম পরমাণু মডেল উপস্থাপন করেন। এই মডেলটি কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর ভিত্তি তৈরি করে এবং বিশেষভাবে হাইড্রোজেন পরমাণুর স্পেকট্রাম ব্যাখ্যা করতে সহায়ক হয়।
বোরের পরমাণু মডেলের মূল তত্ত্ব
1. নির্দিষ্ট শক্তিস্তর বা কক্ষপথ
- পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে (energy level) ঘুরে এবং তারা এই কক্ষপথে ঘোরার সময় কোনো শক্তি বিকিরণ বা শোষণ করে না।
- প্রতিটি কক্ষপথ একটি নির্দিষ্ট শক্তিস্তরের সাথে সম্পর্কিত, যা (যেখানে n হলো কক্ষপথের সংখ্যা)।
- এগুলোকে K, L, M, N... শেলও বলা হয়।
2. শক্তির কোয়ান্টাইজড স্তর
- ইলেকট্রন শুধু নির্দিষ্ট শক্তির (quantized) কক্ষপথে থাকতে পারে এবং এটি ধীরে ধীরে শক্তি হারিয়ে নিউক্লিয়াসে পতিত হয় না।
- প্রতিটি শক্তিস্তরের শক্তি মান E = - (13.6 eV / n²), যেখানে n হলো শক্তিস্তরের সংখ্যা।
3. শক্তি শোষণ ও নির্গমন (Quantum Jump)
-
যদি ইলেকট্রন কম শক্তিস্তর থেকে বেশি শক্তিস্তরে যায়, তাহলে তা নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ করে।
-
আবার, ইলেকট্রন যখন বেশি শক্তিস্তর থেকে কম শক্তিস্তরে ফিরে আসে, তখন তা নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো (Photon) নির্গত করে।
-
এই নির্গত ফোটনগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ধারণ করা যায় বোরের সূত্র দ্বারা:
যেখানে,
- h = প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক (6.626 × 10⁻³⁴ Js)
- ν = নির্গত ফোটনের কম্পাংক
- c = আলোর বেগ
- λ = নির্গত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য
4. কোণীয় ভরবেগের কোয়ান্টাইজেশন
-
ইলেকট্রনের কোণীয় ভরবেগ নির্দিষ্ট মানের হয় এবং এটি প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবকের উপর নির্ভরশীল।
যেখানে,
- m = ইলেকট্রনের ভর
- v = ইলেকট্রনের বেগ
- r = কক্ষপথের ব্যাসার্ধ
- n = কক্ষপথের সংখ্যা (1, 2, 3...)
বোরের মডেলের সফলতা
✅ হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণালী ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়।
✅ ইলেকট্রনের শক্তিস্তর ধারণার মাধ্যমে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করে।
✅ পরমাণুর স্থায়িত্ব ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়, যা রাদারফোর্ডের মডেল ব্যাখ্যা করতে পারেনি।
বোরের মডেলের সীমাবদ্ধতা
❌ শুধুমাত্র হাইড্রোজেন এবং এক-ইলেকট্রন বিশিষ্ট পরমাণুর (He⁺, Li²⁺) জন্য কার্যকর, তবে বহু-ইলেকট্রন বিশিষ্ট পরমাণুর জন্য নয়।
❌ ইলেকট্রন কক্ষপথের আকার ও গতিপথ সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয় না।
❌ হাইড্রোজেনের স্পেকট্রামের সূক্ষ্ম রেখাগুলো ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়।
❌ আয়নিত হাইড্রোজেন ও স্টার্ক এফেক্টের মতো জটিল ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারে না।
পরবর্তী উন্নতি
- ১৯২৬ সালে শ্রোডিঙ্গার (Erwin Schrödinger) তরঙ্গ মেকানিক্স ব্যবহার করে আধুনিক কোয়ান্টাম পরমাণু মডেল তৈরি করেন, যেখানে ইলেকট্রনকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে না রেখে ইলেকট্রন মেঘ (electron cloud) হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
- হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি (Heisenberg Uncertainty Principle) বলেছিল যে, ইলেকট্রনের অবস্থান ও বেগ একসাথে নির্দিষ্টভাবে জানা সম্ভব নয়।
নীলস বোরের মডেল রাদারফোর্ডের সৌর মডেলের উন্নত রূপ এবং এটি কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রথম ধাপ। যদিও এটি পরবর্তী সময়ে আধুনিক কোয়ান্টাম মেকানিক্স দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে, তবে এটি পরমাণুর গঠন বোঝার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদান রেখেছিল।
সৌর মডেল ও নীলস বোরের মডেলের তুলনা ও ব্যাখ্যা
রাদারফোর্ডের সৌর মডেল ও নীলস বোরের কোয়ান্টাম মডেল উভয়ই পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। তবে বোরের মডেল, রাদারফোর্ডের মডেলের সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে আরও উন্নত ও বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। নিচে এই দুটি মডেলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেওয়া হলো:
সৌর মডেল (Rutherford's Atomic Model - 1911)
মূল ধারণা:
- নিউক্লিয়াস: পরমাণুর কেন্দ্রে ছোট, ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস থাকে, যেখানে প্রায় সমস্ত ভর কেন্দ্রীভূত।
- ইলেকট্রন গতি: নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনরা গ্রহের মতো কক্ষপথে (orbit) ঘোরে, যেমন গ্রহগুলো সূর্যের চারদিকে ঘোরে।
- পরমাণুর অধিকাংশ স্থান ফাঁকা: নিউক্লিয়াস ছোট হলেও বেশিরভাগ পরমাণু ফাঁকা স্থান নিয়ে গঠিত।
- পরমাণুর স্থিতিশীলতা ব্যাখ্যায় ব্যর্থ: ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে, চলমান ইলেকট্রন ধীরে ধীরে শক্তি হারিয়ে নিউক্লিয়াসে পতিত হওয়ার কথা, যা প্রকৃতপক্ষে ঘটে না।
সীমাবদ্ধতা:
❌ ইলেকট্রনের পতন ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ।
❌ পরমাণুর নির্দিষ্ট বর্ণালী ব্যাখ্যা করতে পারে না।
❌ কোয়ান্টাম ধারণা অন্তর্ভুক্ত নেই।
নীলস বোরের মডেল (Bohr's Atomic Model - 1913)
মূল ধারণা:
-
নির্দিষ্ট কক্ষপথ: ইলেকট্রন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে (energy level) ঘুরতে পারে, যেখানে তারা শক্তি বিকিরণ বা শোষণ করে না।
-
শক্তি শোষণ ও নির্গমন: ইলেকট্রন যদি উচ্চ শক্তিস্তরে যায়, তাহলে তা নির্দিষ্ট শক্তি শোষণ করে, এবং নিচে নামলে নির্দিষ্ট শক্তির ফোটন নির্গত করে।
-
কোণীয় ভরবেগ কোয়ান্টাইজড: ইলেকট্রনের কোণীয় ভরবেগ নির্দিষ্ট মাত্রার হয়, যা প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবকের ওপর নির্ভর করে:
-
পরমাণুর স্থায়িত্ব: ইলেকট্রন নির্দিষ্ট কক্ষপথে থাকার ফলে এটি শক্তি বিকিরণ করে নিউক্লিয়াসে পতিত হয় না।
-
বর্ণালী ব্যাখ্যা: বোরের মডেল হাইড্রোজেনের স্পেকট্রাল লাইন ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়।
সীমাবদ্ধতা:
❌ শুধুমাত্র হাইড্রোজেন ও এক-ইলেকট্রন বিশিষ্ট পরমাণুর জন্য কার্যকর।
❌ ইলেকট্রনের প্রকৃত তরঙ্গ প্রকৃতি (wave nature) ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ।
❌ কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা (Heisenberg Uncertainty Principle) উপেক্ষা করা হয়েছে।
সৌর মডেল ও নীলস বোরের মডেলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ
বিষয় | সৌর মডেল (রাদারফোর্ড) | নীলস বোরের মডেল |
---|---|---|
পরমাণুর গঠন | নিউক্লিয়াস কেন্দ্রে, ইলেকট্রন কক্ষপথে ঘোরে। | নিউক্লিয়াস কেন্দ্রে, ইলেকট্রন নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে ঘোরে। |
ইলেকট্রনের গতি | গ্রহের মতো কক্ষপথে ঘোরে, শক্তি হারায়। | নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে ঘোরে, শক্তি হারায় না। |
শক্তি বিকিরণ | ক্রমাগত শক্তি বিকিরণ করে, যা পরমাণুর স্থায়িত্ব ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ। | শক্তি নির্দিষ্ট পরিমাণে নির্গত বা শোষিত হয়। |
বর্ণালী ব্যাখ্যা | পরমাণুর নির্দিষ্ট বর্ণালী ব্যাখ্যা করতে পারে না। | হাইড্রোজেনের বর্ণালী ব্যাখ্যা করতে পারে। |
পরমাণুর স্থায়িত্ব | ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ। | স্থিতিশীল পরমাণু ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। |
কোয়ান্টাম ধারণা | অন্তর্ভুক্ত নয়। | কোয়ান্টাইজড শক্তিস্তর ধারণা অন্তর্ভুক্ত। |
রাদারফোর্ডের সৌর মডেল ছিল প্রথম বাস্তবসম্মত পরমাণু মডেল, তবে এটি ইলেকট্রনের শক্তি বিকিরণ ও পরমাণুর স্থায়িত্ব ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়। নীলস বোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে এই সমস্যাগুলো সমাধান করেন এবং হাইড্রোজেনের বর্ণালী ব্যাখ্যা করেন। তবে, তার মডেলও সীমাবদ্ধ ছিল এবং পরবর্তীতে শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ মেকানিক্স ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।
রাদারফোর্ডের সৌর মডেল ও নীলস বোরের পরমাণু মডেল মূলত পদার্থবিজ্ঞান (Physics) বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এটি পরমাণুর গঠন (Atomic Structure) অধ্যায়ে আলোচিত হয়।
নবম-দশম শ্রেণির (SSC) পড়াশোনা
পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় "পরমাণুর গঠন" এর অংশ।
উচ্চমাধ্যমিক (HSC) ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে এটি আরও বিস্তারিতভাবে কোয়ান্টাম মেকানিক্স (Quantum Mechanics) এর সাথে সম্পর্কিত।
রাদারফোর্ড ও নীলস বোরের পরমাণু মডেল রসায়ন (Chemistry) বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এটি মূলত পরমাণুর গঠন (Atomic Structure) এবং ইলেকট্রন বিন্যাস (Electronic Configuration) অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।
রসায়নে এর প্রয়োগ:
- পরমাণুর গঠন:
- নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনের বিন্যাস ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।
- ইলেকট্রন বিন্যাস (Electron Configuration):
- বোরের মডেল ব্যবহার করে বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের ইলেকট্রন বিন্যাস নির্ধারণ করা হয়।
- পরমাণুর বর্ণালী (Atomic Spectra):
- বোরের মডেল হাইড্রোজেনের বর্ণালী রেখাগুলো ব্যাখ্যা করে, যা রসায়নে মৌলিক বিশ্লেষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- আইনাইজেশন শক্তি (Ionization Energy):
- বোরের মডেল ব্যাখ্যা করে যে, পরমাণু থেকে ইলেকট্রন সরাতে কতটুকু শক্তি প্রয়োজন।
- রাসায়নিক বন্ধন (Chemical Bonding):
- ইলেকট্রনের বিন্যাস বুঝলে পরমাণুর আয়নিক ও সমযোজী বন্ধন ব্যাখ্যা করা সহজ হয়।
কোন শ্রেণির রসায়নে থাকে?
✅ নবম-দশম শ্রেণির রসায়ন বইয়ের ২য় অধ্যায় – "পরমাণুর গঠন".
✅ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির রসায়নের প্রথম অধ্যায় – "পরমাণুর গঠন ও পর্যায় সারণি".
✅ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় এটি আরও গভীরভাবে আলোচিত হয়।
0 coment rios: