হান্নান শাহ
এক দৃঢ় নেতা ও উজ্জ্বল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ও সামরিক
![]() |
Towfiq Sultan |
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাসে এক শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আ.স.ম. হান্নান শাহের নাম চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি ছিলেন একাধারে একজন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা, একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ এবং একজন দৃঢ় নেতা। তাঁর জীবন ছিল সাহস, দেশপ্রেম, শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি শুধু একটি পদ বা উপাধি নিয়ে ছিলেন না, বরং দেশের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ঠা এবং সেনাবাহিনীতে অসামান্য অবদানের মাধ্যমে তিনি জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন।
ইতিহাসে হান্নান শাহ
হান্নান শাহ ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার সাগরিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ফকির পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা, ফকির আব্দুল মান্নান শাহ, ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রী। তার পরিবার ছিল শিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন, এবং এতে হান্নান শাহের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা গড়ে ওঠে। তাঁর শৈশব কাটে দেশপ্রেম, শৃঙ্খলা এবং মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষায়।
তিনি ১৯৫৬ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেন এবং পরবর্তীতে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি, কাকুলে ভর্তি হন, যেখানে তিনি ১৯৬২ সালে কমিশন লাভ করেন। পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর তিনি ইঞ্জিনিয়ার কোরে কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং অত্যন্ত দক্ষ, সৎ ও দায়িত্বশীল সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন।
এক দৃঢ় নেতা ও উজ্জ্বল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ও সামরিক
হান্নান শাহ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর মাত্র কিছুদিনেই তাঁর দক্ষতা এবং নেতৃত্বের গুণাবলীর জন্য তিনি সহকর্মীদের কাছে শ্রদ্ধা অর্জন করেন। তিনি ছিলেন একজন মেধাবী, আদর্শবাদী সেনা কর্মকর্তা, যার কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধ তাঁকে দ্রুত পদোন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন এবং সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বন্দি থাকার কারণে তিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি, তবে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তাঁর যোগদান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নতুন উদ্যম এবং দক্ষতা নিয়ে আসে। সেনাবাহিনীতে একটানা কাজের পর ১৯৮১ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
তাঁর সেনা জীবনের পর, তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এ যোগ দেন। বিএনপির একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবে তিনি দেশের গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ করতে থাকেন। তাঁর নেতৃত্বে, বিএনপি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ সালে তিনি বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি দেশের গ্রামাঞ্চলে উন্নয়ন কাজ শুরু করেন এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করেন।
রাজনৈতিক সংগ্রাম ও অবদান
হান্নান শাহ শুধু সেনা কর্মকর্তা বা মন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দৃঢ় রাজনৈতিক নেতা। ১৯৯৯ সালে তিনি গাজীপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বিএনপির বিভিন্ন শাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ২০০১-২০০৬ সাল এবং বিশেষভাবে ২০০৭-২০০৮ সালে বিএনপির সিনিয়র নেতা হিসেবে তিনি দলের ভিতরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল এক সংগ্রামী পথ। তিনি সবসময় জনগণের অধিকার, গণতন্ত্র এবং ন্যায়বিচারের পক্ষে ছিলেন। তাঁর ভাষা ছিল স্পষ্ট এবং জনগণের জন্য তিনি কাজ করতেন। দলীয় কার্যক্রমে তাঁর নিষ্ঠা এবং নেতৃত্বগুণ তাঁকে দলের ভিতরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে আসীন করেছিল। রাজনৈতিক সংগ্রাম ও বিভিন্ন সময় কারাবরণ করলেও, তাঁর আদর্শ কখনো পরিবর্তিত হয়নি। বরং তাঁর সংগ্রাম দেশের প্রতি অঙ্গীকারকে আরো দৃঢ় করেছে।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
হান্নান শাহ ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তাঁর এনজিওপ্লাস্টি (অস্ত্রোপচার) করা হয়। কিছুদিন শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলেও ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক শোকের ছায়া ফেলে। মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা হলে ৩০ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের কাপাসিয়া গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। তাঁর মৃত্যু শুধু বিএনপি বা রাজনৈতিক অঙ্গনে নয়, দেশের সাধারণ মানুষের জন্যও এক বিরাট ক্ষতি ছিল।
হান্নান শাহ ছিলেন এক অসাধারণ রাজনৈতিক নেতা, একজন সৎ ও দক্ষ সেনা কর্মকর্তা এবং একজন ন্যায়পরায়ণ মানবতাবাদী নেতা। তাঁর কর্মজীবন ছিল আদর্শের প্রতীক, এবং তিনি সবসময় দেশের এবং জনগণের স্বার্থে কাজ করেছেন। তাঁর মৃত্যু পরবর্তী সময়েও তাঁর আদর্শ এবং নেতৃত্ব আমাদের কাছে অমর হয়ে থাকবে। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা ও কাজ আমাদের সকলকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।
|
0 coment rios: